গল্পকে কি আদৌ নতুন করে সৃষ্টি করা যায়? নাকি বাতাসের মতোই চারপাশ থেকে আমাদের জড়িয়ে রাখে ওরা; স্থান-কাল-পাত্রের কাঁধে ভর করে ছড়িয়ে যায়, ঘুরে বেড়ায় সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে!
কেন এক কাকডাকা ভোরে আব্দুল মোত্তালেবের লোমশ পাজোড়া শূন্যে ঝুলে থাকে? চর্যাপদের আদি কবি লুইপার সাথে এক বৃষ্টিভেজা অন্ধকার সন্ধ্যায় নিলক্ষেতে আটকে পড়া কয়েকজন যুবকের কী সম্পর্ক? মধ্যদুপুরে জনৈক গৃহিণীর জীর্ণশীর্ণ হাত জানালার বাইরে কাকে খোঁজে? অবিরাম জ্বরের দিনগুলোতে শহরের রাস্তায় হাজির হয় কোন সে আগন্তুক? রোমাঞ্চ, পারিপার্শ্বিক জীবন, রহস্য, আধিভৌতিকতা, দর্শন, পরাবাস্তবতা- এমন অসংখ্য সুতোয় বোনা গল্পে উত্তর মিলবে সব প্রশ্নের। বিচিত্র বিষয়ের আবর্তনেও যার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে বিষণ্ণতার ছাপ, যে বাক্যে মিশে থাকে অশ্রুত অন্ধকার!
যতই দিন যাচ্ছে, উপন্যাসের চেয়ে ছোট গল্পেই বেশি মুগ্ধ হচ্ছি। এতটুকু ক্যানভাসে লেখকেরা তাদের বিচিত্র সব গল্পের যে পসরা বসান, তাতে বুঁদ হতে ভালো লাগে। পড়া শেষ করে গালে হাত দিয়ে বসে ভাবতে ভালো লাগে - কি পড়লাম!
যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকারের বেশ কয়েকটা গল্প পড়ার পর সেই দশা হয়েছে। কি পরিণত লেখার ধরণ, আবার একেকটা গল্পে লেখনীর কি বৈচিত্র! পরাবাস্তব জগতের একটা গল্প শোনানোর পরেই লেখক আমাদের চপেটাঘাত করে নামিয়ে নিয়ে আসবেন ভীষণ রকম বাস্তবে। গল্পগুলোর সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হচ্ছে এর চরিত্রগুলো। মনে হবে, "আরে একে তো চিনি", সেদিনই বাসে দেখলাম!" মোদ্দা কথা পাঠকেরা গল্পগুলোর সাথে কানেক্ট করতে পারবেন সহজেই। প্রায় ক্ষেত্রেই এক অদৃশ্য দেয়াল লেখকের চরিত্র এবং পাঠকের মাঝে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, কেন যেন প্রবেশ করতে দেয় না চরিত্রগুলোর অন্তরে। সে সমস্যায় পড়তে হয়নি। আপনি যে ঘরানার লেখাই পছন্দ করুন না কেন, কিছু না কিছু পাবেন এই বইয়ে।
মোটমাট এগারোটি গল্প নিয়ে "যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার"। আমি যদি রাফি ভাইকে ব্যক্তিগভাবে না চিনতাম, তবুও এই বইটি কেনা হতো, শুধুমাত্র নামের কারণেই। যতবার বইটা হাতে নেই, মনে হয় মেঘদলের শিবু কুমার শীল কানের কাছে ফিসফিস করছেন 'কুমারী... উত্তর দাও তুমি, যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার..."। রেনে গী কাদুর কবিতার সুনীলের অনুবাদে সুর বসিয়ে মেঘদল যেরকম সুবিচার করেছিল, ওয়াসি আহমেদও সুবিচার করেছেন বলতেই হবে। এগারোটা গল্পের সবগুলোই কম বেশি ভালো লেগেছে। বেশি ভালো লেগেছে জীবনের এইসব নিভৃত কুহক, একজন ব্যধিগ্রস্ত মানুষ, কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল এবং সাতটি তারার তিমির।
কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডালে ঝড়ের এক সন্ধ্যায় নীলক্ষেতে চার বন্ধুর আড্ডা হয়ে ঘুরে আসতে পারবেন চর্যাপদের লুইপার জীবন থেকে। পুরাণ, ইতিহাস আর জাদুবাস্তবতার মিশেলে নিঃসন্দেহে সংকলনের সেরা গল্প এটাই। এরপরই থাকবে সাতটি তারার তিমির, রোমান্টিকতা আর দর্শনের মেলবন্ধনে বুকের ভেতরটা একটু হলেও ভারি হতে বাধ্য। জীবনের এইসব নিভৃত কুহকে আশপাশের নিত্য জীবনের প্রতি লেখকের দারুণ অবজার্ভেশনের পরিচয় মিলবে।
ছোটগল্পের সংজ্ঞা, উপযোগীতা- যাবতীয় কঠিন কঠিন টার্ম নির্বিশেষে আমার মনে হয় 'যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার' লেখক ওয়াসি আহমেদের মাইলফলক হয়ে থাকবে। তার প্রথম উপন্যাস "আঁধারের গহীন নিরুদ্দেশে"-ও ছিল ভীষণ সুখপাঠ্য, তবে এখানে লেখক এখানে নিজেকেই ছাড়িয়ে গেছেন। আশা করছি, থ্রিলারের পাশাপাশি জাদুবাস্তবতা ঘরানাতেও তিনি নিয়মিত লেখালেখি করবেন এখন থেকে।
যে লেখক/লেখিকাদের ব্যক্তিগতভাবে চিনি, তাদের বই পড়ার সময় আমার ভেতর একধরনের আতংক কাজ করে। যদি পছন্দ না হয়? তাদের ব্যাপারে কি আমার ধারণা বদলে যাবে? মানুষ হিসেবে তারা যতোটা ভালো, লেখক হিসেবে যদি না হন? এরপর আড্ডা দেয়ার সময় যদি তাদের লেখার প্রসঙ্গ আসে, সত্যি কথা বলবো না ভদ্রতা করবো? তেমন আতংক নিয়েই ওয়াসি আহমেদ-এর বইটা পড়া শুরু করেছিলাম। তিনটা গল্প পড়ার পর আতংকের জায়গা নিলো স্বস্তি, আরো দু’টো পড়ার পর রীতিমতো অবাক হয়ে গেলাম। ��াকিগুলো শেষ করতে বেশিক্ষণ লাগেনি। মৌলিক লেখক হিসেবে ওয়াসির যাত্রা স্বল্প সময়ের, কিন্তু এরমধ্যেই ও বেশ অনেকখানি পথ পার করে ফেলেছে। ‘...অশ্রুত অন্ধকার’-এর গল্পগুলো তার নিরেট প্রমাণ। অনেক ধরনের গল্প আছে এখানে: থৃলার, জাদুবাস্তব, অতিপ্রাকৃতিক, ‘জীবনমুখী’...যেমন পাঠকই আপনি হন না কেন, পছন্দের কিছু না কিছু খুঁজে পাবেন এ বইতে। তবে গল্পগুলো যতোই আলাদা ঘরানার হোক, প্রায় সবগুলোর মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। একটা হচ্ছে চরিত্রায়ণ। ওয়াসি যে চরিত্রগুলো তৈরি করেছে তারা সবাই খুব পরিচিত, কিন্তু তাদেরকে আমরা অন্য গল্পে দেখিনি। দেখেছি বাস্তবে। একদল কাছের বন্ধু, অপেক্ষারত গৃহবধু, প্রেমিক, প্রেমিকা, সন্তান, পিতামাতা-সবাই কথা বলে খুব সহজ ভঙ্গিতে। ডায়ালগ মনে হয় না। সামান্য বর্ণনা থেকেও বোঝা যায় যে এই মানুষগুলোর দৈনন্দিন জীবন কেমন। আরেকটা হচ্ছে প্রেক্ষাপট। চরিত্রদের সাথে তাল মিলিয়ে গল্পগুলো আমাদের চেনা শহরে বসানো, ছোট ছোট পাড়ায় বসানো, বাংলাদেশে বসানো। এই পরিবেশে যখন আচমকা একটা অতিপ্রাকৃত ঘটনা ঘটে, না চমকে উপায় থাকে না। পুরো বইয়ে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে ‘জীবনের এই নিভৃত কুহক’ এবং ‘পাঞ্চ বি ডাল…’ গল্পদু’টো। ওয়াসি প্রচুর বই পড়ে, এবং যে লেখকেরা ওকে প্রভাবিত করেছে তার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায় এই লেখাগুলো পড়লে। লেখকের জন্য আমার পরামর্শ হবে থৃলার-এর থেকে জাদুবাস্তব/বাস্তবমুখী লেখার দিকে বেশি মনোযোগ দেয়া। এটা একান্তই ব্যক্তিগত মতামত, তবে মনে হয়েছে এ ঘরানার লেখাতে সে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। যে দু’টো গল্প আমার ভালো লাগেনি, যে কারণে এক তারকা কাটলাম, দু’টোই থৃলার ঘরানায় পড়েছে। ‘…অশ্রুত অন্ধকার’-এর পাশাপাশি আরেকটা বই পড়ছিলাম: বাংলার সমকালীন জাদুবাস্তব গল্প। মনে হয়েছে অশ্রুত অন্ধকারের বেশ কয়েকটা গল্প সে বইয়ে স্থান পাবার মতো। এমনকি সে বইয়ের কিছু গল্পের থেকেও উন্নতমানের। আতংক কেটে গেছে।
সংক্ষোভ:- বেশ ক্রিপি আর অস্বস্তিকর একটা গল্প। চাইল্ড সাইকোলজি নিয়ে। একটা বাচ্চার তার সদ্যজাত ছোট বোনের প্রতি মনোভাব নিয়ে। আগেও পড়েছিলাম নিশুতি সংকলনে। এবারও ভালো লেগেছে।
জীবনের এইসব নিভৃত কুহক:- এক মধ্যবিত্ত গৃহিনীর একাকিত্বের রোজনামচা। কিছুটা পরবাস্তবতার ছাপ পেয়েছি। ভালো লেগেছে।
একজন ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ:- একজন আর্টিস্ট, নির্যাতন, নিপীড়নের স্বীকার হয়ে কিভাবে একজন উন্মাদে রূপান্তরিত হয় তার ফিরিস্তি। বেশ ভালো ছিল। বিশেষ করে গল্প বলার ধরনটা।
কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল: চর্যাপদ মিথলজি, রাজা ধর্মপাল ও লুইপাকে নিয়ে লেখা অসাধারণ এক গল্প। গাছকে নিয়ে দারুণভাবে লেখা হয়েছে কাহিনীটা। সম্ভবত সংকলনের সেরা গল্প। চর্যাপদ মিথলজির এরকম ব্যবহার পূর্বে দেখিনি।
বিকৃতি: বর্তমান যুগের তরুণ প্রজন্মের শো অফ কতটা হতাশাজনক সেটাই তুলে ধরা হয়েছে দারুণভাবে। ওভারঅল মোটামোটি লেগেছে গল্পটা।
জ্বরের দিনগুলোতে এক কাল্পনিক নগরীর মিথ্যা উপাখ্যান: সংকলনের সবথেকে সাদামাটা গল্প আমার মতে। তবে হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালাকে ভিন্নভাবে পোট্রেট করার চেষ্টা বাহবা'র যোগ্য।
সাতটি তারার তিমির: একাধারে রোমান্টিক ও হারানোর বেদনা, বিষণ্নতা ও একাকিত্বের আখ্যান। হারুকি মুরাকামী ভক্তদের ভালো লাগবে।
অবান্তর অথচ অকাট্য: একটি লোকের আত্মহত্যা ও পারিপার্শ্বিক ব্যাপার স্যাপার নিয়ে গড়ে উঠেছে গল্পের কাহিনী। কিছুটা উইয়ার্�� ফিকশন টাইপের। একইসাথে অস্বস্তি ও যন্ত্রনার অনুভূতি দিয়েছে গল্পটা।
চক্র: কোনোরকম কষ্টে শিষ্টে চলা এক যুবকের আখ্যান। জাদুবাস্তবতার ছাপ রয়েছে। খুব একটা ভালো লাগেনি কেন যেন।
নিয়তি: বিদেশি গল্প অবলম্বনে। ট্র্যাপে পড়া এক লোকের ট্র্যাপ থেকে বের হওয়া নিয়েই লেখা। দারুণ লেগেছে।
তিনটি বাজে গল্প:- আশেপাশের বিভিন্ন অবজেক্টের সাহায্য তিনটা ��োট্ট গল্পে তুলে ধরা হয়েছে মানবজীবনের নিত্য সমস্যাগুলোকে। বাজে গল্প বলা চলে না আরকি। দুই নম্বরটা দারুন বিশেষ করে।
যে বা���্যে অশ্রুত অন্ধকার লেখক ওয়াসি আহমেদের প্রথম গল্প সংকলন। পাঠকরা একাধারে থ্রিলার, পরবাস্তব, জাদুবাস্তবতা, উইয়ার্ড ফিকশন ও অবজেক্ট ভিত্তিক লেখার স্বাদ পাবেন। সবমিলিয়ে বেশ ভালো একটা একক ছোটগল্পের সংকলন। গল্পগুলোর সবথেকে স্ট্রং দিক লেখনশৈলী। লেখকের দারুণভাবে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা আটকে রাখবে আপনাকে। ছোট্ট ছোট্ট গল্পগুলো বেশ ব্যপ্তি রেখে যায় মনে। দ্রুত পড়ে ফেলা যায়। এদিক দিয়ে লেখকের দক্ষতা প্রশংসার দাবিদার। উপভোগ্য ছিল পড়ার পুরো সময়টা।
যে বাক্যে অশ্রুত অন্ধকার ওয়াসি আহমেদ পৃষ্টা: ৯৬ অবসর প্রকাশনা
রাফি ভাইয়ের লেখার হাত দারুণ। সেটা উনার প্রথম বই "আঁধারের গহীন নিরুদ্দেশে" বইটি পড়ার পরই বুঝতে পেরেছিলাম। উনার ছোট গল্প সংকলন বের হবে শুনে আমি দারুণ আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম। বইটা উনার কনফোর্ট জোন থেকে লেখা, মানে রাফি ভাই এখন থেকে এই জনরায় লিখবেন, আর এই বইটা হচ্ছে তার শুরু। সেই হিসাবে শুরুটা দারুণই বলতে হবে। বেশ কিছু গল্প এক্সসিলেন্ট আর বেশ কিছু গল্প সাধারণ। আর দুই একটা গল্প আমি বুঝি নাই :p(তাই ওইগুলা সম্পর্কে কোন মন্তব্য নাই :D )
"সংক্ষোভ" গল্পটি থ্রিলার ঘরনার। বাচ্চাদের মাইন্ড কমপ্লেক্সিজিটি নিয়ে। বেশ ভালো লাগল। "একজন ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ" সাইকোলজিক্যাল ঘরনার। এইটাও দুর্দান্ত। "বিকৃতি" গল্পটি যেন আমাদের বর্তমান সমাজের প্রতিচ্ছবি। "চক্র" গল্পটি পরাবাস্তব জনরার সুন্দর একটি গল্প। "সাতটি তারার তিমির" দর্শন এবং রোমান্টিকতার মিশলে দারুণ একটা ছিমছাম গল্প "নিয়তি" গল্পটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রতিটি পাপেরি প্রাশ্চচিত্ত আছে।
"অবান্তর অথচ অকাট্য" এবং "তিনটি বাজে গল্প" বুঝি নাই -_-
তবে এই বইয়ের সবচেয়ে সেরা গল্প হচ্ছে "কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল" গল্পটি। পরাবাস্তব, মিথ, ফ্যান্টাসি, ইতিহাস কি যেন ছোট্ট একটা গল্পে। মুগ্ধ হয়ে যাবার মতন একটা গল্প।
সর্বোপরি বলতে হয়, বইটিতে গল্পের চেয়ে লেখার কারুকাজ চোখে পড়ার মতন। গল্গগুলো আসলে বোনাস। আশা করি সামনের রাফি ভাই এই জনরায় আরও লিখবেন।
ছোটগল্পের সংজ্ঞা, গুণাবলি, বাধ্যবাধকতা ইত্যাদি নিয়ে অনাদিকাল থেকে সাহিত্যজগতে নানা মুনির নানা মত চলে আসছে। আমার অবশ্য সেসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। লেখা এক পৃষ্ঠা হোক বা একশো, পড়ে কতটুকু তৃপ্তি আসে সেটাই আসল। আর এক্ষেত্রে বলব, এই বইটা সময় এবং পয়সা দুই-ই উসুল করেছে।
গতকাল রাতে ঘুমানোর আগে বইটা হাতে তুলে নেয়া। ভেবেছিলাম ছোট ছোট লেখা, রসিয়ে রসিয়ে কয়েকদিন লাগিয়ে ভাগে ভাগে পড়ব। কিন্তু সম্বিত ফিরল রাত চারটার কিছু পর, উল্টাতে উল্টাতে বইয়ের শেষাংশে সাদা কাগজ বের হওয়ার সময়।
৯৬ পৃষ্ঠার হ্যাংলাপাতলা বইটাতে স্থান পেয়েছে লেখকের বিভিন্ন সময়ে লেখা মোট ১১টি ছোটগল্প। ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের এই লেখাগুলোর বিস্তারিত বর্ণনায় আমি যাব না, যাওয়া উচিতও না। কারণ, দুই লাইনে এমন লেখার সংক্ষেপন করা আসলে উচিত নয়। ব্যাক-কাভার থেকে কয়েক লাইন উদ্ধৃত করছি। "কেন এক কাকডাকা ভোরে আব্দুল মোত্তালেবের লোমশ পা-জোড়া শূন্যে ঝুলে থাকে? চর্যাপদের আদি কবি লুইপার সাথে বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় নীলক্ষেতে আটকে পড়া যুবকদের কী সম্পর্ক? মধ্যদুপুরে জনৈক গৃহিণীর জীর্ণশীর্ণ হাত জানালার বাইরে কাকে খোঁজে? অবিরাম জ্বরের দিনগুলোতে শহরের রাস্তায় হাজির হয় কোন সে আগন্তুক?"
আমাদের জীবন জুড়ে ঘটতে থাকা পারিপার্শ্বিকতা, রোমাঞ্চ-রহস্য, নিষ্ঠুরতাকে দর্শন আর পরাবাস্তব জগতের ভাষায় নিপুণ হাতে বুনে গল্পগুলো একসাথে জুড়েছেন লেখক। তার প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ না জানিয়ে উপায় নেই। সাধারণ ঘটনাবলিকে কীভাবে ভাষার গাঁথুনিতে জাদুময় রূপ দেয়া যায়, তারই অকাট্য প্রমাণ এই বই। পড়তে পড়তে কখনও হেসে উঠেছি সকৌতুক বাচনভঙ্গিতে, কখনও ডুবে গিয়েছি ইতিহাসের অতলে, কখনওবা কেঁপে উঠছি নিষ্ঠুর বাস্তবতা লক্ষ্য করে।
সাহিত্যের মানবিচারে গল্পগুলো কতটা উৎরাবে, তা হয়তো আমি বলতে পারব না। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত, পাঠকের মনে রেশ রেখে যাবার কাজটাতে লেখক সফল। তার কাছে অনুরোধ থাকবে, লেখালেখির এই ধারাটা যেন ভবিষ্যতেও ধরে রাখেন।
এবছর আমার পড়া সেরা বইগুলোর মধ্যে প্রথম কাতারে থাকবে 'যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার'। জীবনবোধ, রহস্য-রোমাঞ্চ, ইতিহাসের পাশাপাশি দর্শন এবং পরাবাস্তবতায় আগ্রহ আছে এমন পাঠকদের জন্য হাইলি রেকমেন্ডেড।
ও হ্যাঁ, সজল চৌধুরীর প্রচ্ছদের তারিফ না করলেই নয়। প্রিমিয়াম প্রোডাকশনের জন্য অবসর প্রকাশনীকেও সাধুবাদ।
“Short stories are tiny windows into other worlds and other minds and other dreams.” ― Neil Geiman - যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার - "যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার" মূলত ১১টি ছোটগল্পের একটি গল্প সংকলন। গল্পগ্রন্থটি এবারের বইমেলায় অবসর প্ৰকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। - সংক্ষোভ : "যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার" বইয়ের প্রথম গল্প এটি। একটি পরিবারের কোরবানির ঈদের এক ঘটনা নিয়ে আবর্তিত হয়েছে। প্রেডিক্টেবল লাগলো। - জীবনের এইসব নিভৃত কুহক : এক গৃহিণীর নিত্যদিনের কাহিনী। জীবনধর্মী হিসেবে খারাপ না। - এক জন ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ : সিরিয়াল কিলিং নিয়ে একটি ছোটগল্প। মোটামুটি। - বিকৃতি : গ্রামের বাড়িতে গিয়ে এক কবিরাজের দেখা এক লোকের সাক্ষাৎ নিয়ে মূল ঘটনা। ভালোই লাগলো। - জ্বরের দিনগুলোতে এক কাল্পনিক নগরীর মিথ্যা উপাখ্যান : হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার বর্তমান সময়ের রিটেলিং। বেশ মানানসই বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে। - সাতটি তারার তিমির : রোমান্টিক ধাঁচের লেখা। এটিও মোটামুটি লাগলো। - অবান্তর অথচ অকাট্য : Kafkaesque ধরণের লেখা, গল্পের চেয়ে এর লেখনী ভালো লেগেছে। - চক্র : জাহিন নামের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক ছাত্রের জীবনের এক দুষ্টচক্র নিয়ে কাহিনী। অনেকটা ম্যাজিক রিয়েলিজম ধাঁচের লেখা। সে হিসেবে ভালোই। - নিয়তি : আসগর সাহেব নামের এক লোককে ব্ল্যাকমেইল করার কাহিনী। বেশ ভালো লাগলো। - তিনটি বাজে গল্প : এগুলিও Magic realism/Kafkaesque ঘরানার গল্প, এ হিসেবে ঠিকই আছে। - এবার আসি সংকলনের সবচেয়ে প্রিয় গল্প, "কা আ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল" এ। এক বৃস্টিভেজা বিকালে চার বন্ধুর শোনা এক অদ্ভুত কাহিনী।এই গল্পের প্রথম থেকে শেষ, পুরোটাই দুর্দান্ত। - "যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার" বইতে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে এর লেখার বুনোট। কয়েকটি গল্পের লেখনী একেবারেই মুগ্ধ করার মতো। বইটির প্রচ্ছদটি অত্যন্ত চমৎকার। "যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার" বইটির ভিতরের ইলাস্ট্রেশন, বইয়ের বাধাই, কাগজের মান সবকিছুই উন্নতমানের। মোটাদাগে বইয়ের প্রোডাকশনে আমি সন্তুষ্ট। সামনে লেখকের কাছ থেকে এ ধরণের গল্পগ্রন্থ পাবো এই আশা করি।
ছোটগল্প নিয়ে উইলিয়াম ফকনরের একটা উক্তি আমার ভীষণ প্রিয়। তিনি বলেছেন,'I am a failed poet. Maybe every novelist wants to write poetry first, finds he can’t and then tries the short story...' কী অসাধারণ একটা কথা! কবিতা লেখার ব্যর্থ প্রয়াস থেকে জন্ম নেয় ছোট গল্প। অবশ্য এই ব্যর্থতাকে মহান ব্যর্থতা বলে আখ্যায়িত করা যায়। সেই মহান ব্যর্থতার ছোঁয়া লেগেছে Wasee Ahmed Rafi ভাইয়ের মস্তিষ্কে ও মননে। তার সদ্য ভূমিষ্ঠ প্রথম গল্প সংকলন 'যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার' নিয়ে কিছু কথা বলবার লোভ সামলাতে পারলাম না। সরাসরি চলে যাই গল্পগুলোর কলকব্জার গভীরে। ১. সংক্ষোভঃ ছাপোষা একঘেয়ে জীবন লালিত করা এক দম্পতির গল্প। একই স্কেলে মেপে মেপে দিনের পরিমাপ নেয় তারা। কে জানতো? এই একঘেয়ে স্কেলের পরিমাপে করাতাঘাত করবে তাদের প্রথম কন্যা নুসরাতের শিশু মনের জটিল দুর্বোধ্য মানসিকতা? গল্পের শুরুতে একটা আর্টওয়ার্ক রয়েছে। যেখানে মানুষের মনের শতশত জটিলতার মারপ্যাঁচ চিহ্নিত রয়েছে। বিষণ্ণ সুন্দর ছাপ রয়েছে গল্পটায়। প্রিয় বাক্য 'মিডিয়াম রেয়ার বিফ স্টেক, গ্রিল, উমম...দারুণ একটা জিনিস...'
২. জীবনের এইসব নিভৃত কুহকঃ নিম্ন মধ্যবিত্ত এক রমণীর খাঁচা বন্দী একাকিত্বের গল্প। যে স্বামীর ভোগের বস্তু, পথচলা হকারের অযথা কথার সঙ্গী অথবা কারো কবিতার দুঃখী আত্মা। গল্পের শুরুতে আর্টওয়ার্কে যে নগ্ন নারী নিজেকে কচ্ছপের মতো গুটিয়ে নিতে চাইছে, সে কি রাবেয়া? প্রিয় বাক্য 'সেই সবুজ রঙ দেখেই হয়তো কোন এক দুপুরে রাবেয়ার মনে পুঁইশাক খাবার প্রচণ্ড ইচ্ছে জেগে ওঠে।
৩. একজন ব্যাধিগ্রস্ত মানুষঃ অন্ধকার শৈশব, একাকী কৈশোর এবং বিপন্ন যৌবনের বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত হওয়া এক আর্টিস্টের গল্প। যে জীবনের কাছে অসহায় আকুতি করে বলে ওঠে, 'বিশ্বাস কর, আমি এরকম হতে চাইনি...' গল্পের শুরুর আর্টওয়ার্কে দেখি ব্যাধি-তরঙ্গে আচ্ছাদিত এক মুখাবয়ব আকাশের দিকে চেয়ে আছে...।
৪. কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডালঃ বৃক্ষ নিয়ে এমন অসাধারণ গল্প সচারাচর দেখা যায় না। যার সাথে ইতিহাস মিশে এক অদ্ভুত রহস্যের ইঙ্গিত দিয়েছে। লুইপা'র মতো মহাবৃক্ষের সন্ধানে আমরা মানুষ চিরকালই ব্যস্ত ছিলাম। প্রিয় লাইন 'এই মেট্রোপলিসে যারা সামান্য ঝড়-বৃষ্টিতে মারা যায়, তাদের পরিচয় আমাদের না জানলেও চলবে'। আর্টওয়ার্ক-এ দেখতে পাই, একজন ধ্যানমগ্ন যোগীর বৃক্ষের সাথে যোগসূত্র।
৫. বিকৃতিঃ সাদামাটা গল্প দিয়ে লেখক বুঝাতে চেয়েছেন দুই জগতের দুই ভিন্ন অথচ অভিন্ন বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষদ্বয়কে। প্রিয় লাইন, 'ধ্যানে মিলে জ্ঞান, অধিক জ্ঞানে অজ্ঞান'। আর্টওয়ার্কে একটা বাল্ববন্দী মস্তিষ্ক দেখে কিছু বুঝতে পারছে অবশ্যই।
৬. জ্বরের দিনগুলোতে এক কাল্পনিক নগরীর মিথ্যা আখ্যানঃ কেমন হতো? যদি এক বাঁশিওয়ালা এসে শহরের সব মশা তাড়িয়ে দিতো? আদতে শহর��র স্বেচ্ছায় অন্ধ হর্তাকর্তাদের ওপর কোনও হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার চরম ঘৃণা মিশ্রিত হতাশার কথাই বলা হয়েছে। প্রিয় বাক্য, 'মিথ্যা কথা! এই শহরে তেমন মশা নাই'।
৭. সাতটি তারার ��িমিরঃ জীবনানন্দের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া সব হারানো এক বিকলাঙ্গ স্মৃতি পুঁজি করে বেঁচে থাকা প্রেমিকের গল্প।
৮. অবান্তর অথচ অকাট্যঃ সাধারণ একটা দৃশ্যপটকে শব্দের রঙে রঞ্জিত করে তুলেছেন লেখক। প্রিয় বাক্য, ' দায়িত্ব, বিবেক, সংসার নামক ভারী ভারী শব্দকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ঝুলতে থাকে সদ্য পরিচয়বিহীন, লুপ্তপ্রাণ, মৃতদেহ'।
৯. চক্রঃ জাহিনের দীনহীন জীবনের আখ্যান। জাদুবস্তবতায় যার মৃত্যু হয় প্রতিদিন।
১১. তিনটি বাজে গল্পঃ ক. প্রথম বাজে গল্পঃ মানুষের জীবনে হতাশা হচ্ছে ধ্রুবক; যাকে আশার আলো দিয়ে সারাক্ষণ আবৃত করতে ব্যস্ত আমরা। খ. দ্বিতীয় বাজে গল্পঃ সুখ নষ্ট হবার বাটারফ্লাই এফেক্টের কথা বলেছেন লেখক, অথবা বলেছেন সুখের ইকোসিস্টেমের নিম্নস্তরের খাদকের কথা। যাদের চাহিদা কম, সুখ বেশী। গ. তৃতীয় বাজে গল্পঃ মানুষ অথবা পশুর বেঁচে থাকার প্রাচীন গুপ্ত রহস্যের এক অদ্ভুত বর্ষণের চিত্রপট ভেসে উঠেছে এইখানে।
ওয়াসি ভাইয়ের লেখার হাত দারুণ স্বীকার করতেই হবে। কোনো গল্পে ব্যবহার করেছেন শাব্দিক বেড়াজাল, আবার কোনো গল্পে সোজাসাপ্টা বর্ণনা। গল্পের টোন ধরে রেখেছেন শুরু থেকে শেষ অব্দি। মূল দর্শনটা ঠিক রেখেছেন। উপমার ক্ষেত্রে জীবনানন্দ বেশ প্রভাব ফেলে তার উপর। তবে ক'জন সেই মহান প্রভাবে প্রভাবিত হতে পারে? নিশ্চয়ই ভাগ্যবান লেখকেরা। এই বইটির প্রতিটি গল্প এক একটি প্রশ্ন চিহ্ন রেখে যায়। যদি প্রশ্নবিদ্ধ হতে চান তবে বইটি অবশ্যই পড়বেন। আর আর্টওয়ার্কগুলো ছিল ভাবনার জগতে ঠেলে দেবার মতো! প্রচ্ছদ নিয়ে আর কী বলব? পেস্ট কালারের প্রচ্ছদে সমগ্র বইয়ের পূর্বাভাস দিয়েছেন সুনাম খ্যাত প্রচ্ছদকার সুলতান আযম সজল।
ছোট গল্পের সংকলন বই আমি পড়ি না ডরে! কি ডর? মানে আমার কথা হইলো বই হয় ভালো হইবো না হয় খারাপ হইবো। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যেই বইটা একই গতিতে (এইখানে গতি মানে লেখার মান, গল্পের ফ্লো, স্টোরী বিল্ড আপ, ক্যারেক্টারাজেশন ইত্যাদি সব বুঝাইছি) চলে সেইটা ভালো বই। আর যেইটা কখনো ব্যাপক ভালো, কখনো এক্কেরে খারাপ, কখনো আবার মিডিয়াম গতিতে চলে সেই বইডারে ভাল্লাগে না। আর ছোট গল্পের সংকলনের ক্ষেত্রে ভালো খারাপের উঠানাম এক্কেরে মাস্ট বলা যায়। তবে এই বইটা সেই সমস্যাটা পুরাপুরি কাটায়ে না উঠলেও এক্কেরে মাঠে মারা যায় নাই।
যেমন : ‘কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল’ যেই লেভেলের গল্প তার সাথে ‘তিনটি বাজে গল্প’, ‘নিয়তি’ একেবারেই যায় না। ‘কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল’ যেমন গল্পে স্ট্রং, তেমনি লেখার দিক দিয়াও স্ট্রং। আর সেই সাথে যে লুইপাকে নিয়ে পরিমাণ এক্সক্লুসিভ ইনফরমেশন আছে এই বইতে, মারহাবা মারহাবা। এই বই পড়ার আগে জানতামই না, ‘লুইপা’ মানে ‘যে মাছের অন্ত্র ভক্ষণ করে’! সব মিলায়ে এই গল্পটা এক্কেবারে ৫ এ ১০ টাইপের আর কি। লেখকরে সেলাম।
এরপর চাইল্ড সাইকোলজি নিয়ে লেখা ক্রিপি টাইপের গল্প ‘সংক্ষোভ’ পড়ে বেশ ভালোই লাগছে। ‘জ্বরের দিনগুলোতে এক কাল্পনিক নগরীর মিথ্যা উপাখ্যান’ গল্পে যেভাবে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালাকে আনা হয়েছে এটা বেশ ভাল্লাগছে। ‘সাতটি তারার তিমির’ নামে রোমান্টিক যে গল্পটা আছে ওখানে লেখক আবেগকে বেশ গুছিয়ে তুলে ধরেছেন এবং এটা মোটামুটি ভালো লেগেছে। ব্যস এ পর্যন্তই শেষ, মোট ১১ টি গল্পের আর কোন লেখা ভাল্লাগে নাই। ‘অবান্তর অথচ অক��ট্য’ নামের গল্পটা পড়ে মনে হইছে, লেখক এখানে ভাষা ও শব্দের মারপ্যাঁচ দিয়া অ্যাবস্ট্রাক্ট কিছু তৈরি করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মাথায় ঘিলু কম দেইখা, আমি বুঝতেও পারি নাই আর এ গল্প ভালোও লাগে নাই। ‘চক্র’, ‘জীবনের এইসব নিভৃত কুহক’, ‘একজন ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ’, ‘বিকৃতি’ পইড়া মনে হইছে এইগুলা নিয়া কথা কওনের কিছু নাই। মানে এইডি ভালোও না, খারাপ বললেও ঠিক হইবো না।
বহুদিন বাদে এক রাতে এক বসায় পড়া বই। গল্পের ধরন এবং জনরা, সাহিত্যের এ মাথা থেকে ও মাথা ছুঁয়েছে প্রায়। কিছু গল্প বেশ, কিছু মোটামুটি। কিন্তু প্রায় সবগল্পেই উপস্থিত শক্তিশালী সুখপাঠ্য প্রোজ। rating - 3.4/5
কুমারী, উত্তর দাও তুমি যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার আমার হৃদয় প্রবল ঝোঁকে চাপ দেয় তোমার হৃদয়ে! যদি কখনও দেখি রূপান্তরে তোমার অস্থিরতা তবে সেই অস্থিরতায় আমি তোমাকে প্রেমের আগে তোমার প্রেমকে ভালবাসি। আমি তোমাকে প্রেমের আগে তোমার প্রেমকে ভালোবাসি…
মূল: ফরাসি কবি রেনে গী কাদু ।। ভাষান্তর: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ।। সুর: মেঘদল ব্যান্ড
গল্প - সাহিত্যের একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গল্প বলতে��� যেন বুঝায় ছোটগল্প। আর ছোটগল্পের সংজ্ঞা? সে তো বিস্তর এক সাহিত্যিক তর্ক-বিতর্কের ব্যাপার। তবে এডগার অ্যালান পো জানান যে, আধা ঘণ্টা থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে যে রচনা এক নিমেষে পড়ে শেষ করা যায় তাকেই ছোটগল্প বলা যেতে পারে। অথবা যে কোনো সাহিত্যই যদি একবসায় পড়ে ফেলে যায় তাকেও ছোটগল্প বলা যেতেই পারে। আবার রবীন্দ্রনাথ সুর করে ছোটগল্পের সংজ্ঞায় বলেন -
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে শেষ হয়েও হইল না শেষ।
যাক সংজ্ঞার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বরং পিছলে নেমে যাওয়া যাক অন্য প্রসঙ্গে। ছোটগল্প বাস্তব জীবনের খণ্ডিত অংশ কিংবা পুরো জীবনের সামগ্রিক চিত্র বিশেষ। বাহুল্যতা বর্জিত, সীমাবদ্ধ চরিত্র আর সীমিত পরিসরের সাহিত্যকর্ম হিসেবেই প্রসিদ্ধ ছোটগল্প। কিন্তু এর ব্যাপকতা বিশাল আর বিস্তৃত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যাপকতা আর বিশালতার পরিমাপ করাটাও অনুমানের বাহিরে। একটা বিন্দু অণু থেকে মহাবিশ্বের যে ব্যাপকতা তেমনই একটা ছোটগল্পে যেন বিন্দুতে সিন্ধুর বিশালতা।
প্রতিটা মানুষের চিন্তাধারাই অনন্য। যেজন্য একজন লেখকের চোখে ধরা পড়ে জীবনের অন্য রঙ আর ঢঙগুলো। আর সাধারণ জীবনের সেই বৈচিত্র্যতার উপস্থাপন পড়ে পাঠক ভাবে, আরে এ তো আমার চেনা গল্পই। অতি নিমেষেই ডুবে যায় পাঠক সেই জানা বৈচিত্র্যতার অদেখা জীবনচরিতে। আর সেজন্যই চিরন্তন সত্যটা জেনেও পাঠক পরাবাস্তব এক জগতে নিজেকে নিয়ে দাঁড় করায়। কেবলই কি তা লেখকের লেখনশৈলীতে মুগ্ধ হয়ে?
মোটেই নাহ! কেননা, পাঠক নিজেও চায় নাগরিক জঞ্জাল থেকে ক্ষণিকের বিরতি নিতে। আর বিরতিটাই যখন ভাবের খোরাক যুগিয়ে পাঠককে ঋদ্ধ করে তখন লেখক যেন নিজের সার্থকতাকে স্বচক্ষে দেখতে পারে। ছোটগল্প এমনই অ���্ভুত। চেনা জগতের অচেনা রূপ। কখনোবা তা আনন্দে দেয়; কখনোবা বেদনা; অথবা বিষণ্ণতায় মোহগ্রস্ত করে ফেলে নিমেষেই। ছোটগল্প বাস্তব জীবনের খণ্ডিত অংশ কিংবা পুরো জীবনের সামগ্রিক চিত্র বিশেষ।
হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয় সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয় এ কথা খুব সহজ, কিন্তু কে না জানে সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়। শঙ্খ ঘোষ
তরুণ এবং সদ্য গল্পকারের খাতায় নিজের নাম লেখানো ওয়াসি আহমেদের গল্পগুলোতে ফুটে উঠেছে তেমনই চেনা জগতের পরাবাস্তব দিকগুলো। মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, পারিপার্শ্বিক পরাবাস্তবতা, বিকৃত মানসিকতার অবিকৃত উপস্থাপনা, কালোত্তীর্ণ আধিভৌতিকতা, দর্শন কপচানো বিকৃত মানসিকতা, নাগরিক জঞ্জালের ভিড়ে এক টুকরো মিথ্যে আশ্বাস, অতীব আবেগঘন এক প্রণয়াকাঙ্ক্ষা, বাস্তব জীবনের অবান্তর এক গল্প, আতঙ্কের ফাঁসে আটকে পড়া মানবজনম, বাস্তব জীবনের চিরাচরিত নিয়তি এবং প্রতীকী গল্পের বাজেভাবে উপস্থাপন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুদিত ফরাসী কবি রেনে গী কাদুর কবিতার পঙক্তি হয়ে উঠেছে ওয়াসি আহমেদের গল্পগ্রন্থের শিরোনাম। এই কবিতাকেই প্রেমময় এক আবেগঘন গানে রূপ দিয়েছে মেঘদল ব্যান্ড। যে গানের প্রতিটা শব্দ, সুর আর তাল শ্রোতাকে অদ্ভুত এক ঘোরলাগা ভাব উপহার দেয়। যেন সেই ঘোরলাগা ভাবটাকেই মেঘদলের কাছ থেকে ধার নিতে লেখকের এই প্রয়াস। শিরোনামের সঙ্গে প্রচ্ছদে ফুটে উঠেছে গল্পের আবহ। সবজেটে রঙের মলাটটা তাই মানানসই হয়ে গেছে শিরোনামেই।
এরকমই রহস্যে ঘেরা, নাটকীয়তায় পূর্ণ, পারিপার্শ্বিক জীবনযাপনে পরিপূর্ণ এগারটি গল্পটিকে এক সুতোয় বোনা গল্পগ্রন্থ - “যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার”। কখনো রহস্য, কখনোবা পারিপার্শ্বিক জীবন, কখনো রোমাঞ্চ, কখনোবা আধিভৌতিকতা, অথবা পরাবাস্তবতার জালে বোনা গল্পগুলোতে, উত্তেজনার উত্থানপতন হলেও ভাষাগত দক্ষতার প্রয়োগ হয়েছে ব্যাপকভাবে। আর তারই খানিকটা প্রমাণ হয়তো লেখক দিতে চেয়েছিলেন প্রচ্ছদপটে -
"কেন এক কাকভেজা ভোরে আব্দুল মোত্তালেবের লোমশ পাজোড়া শূন্যে ঝুলে থাকে? চর্যাপদের আদি কবি লুইপার সাথে এক বৃষ্টিভেজা অন্ধকার সন্ধ্যায় নীলক্ষেতে আটকে পড়া কয়েকজন যুবকের কী সম্পর্ক? মধ্যদুপুরে জনৈক গৃহিণীর জীর্ণশীর্ণ হাত জানালার বাইরে কাকে খোঁজে? অবিরাম জ্বরের দিনগুলোতে শহরের রাস্তায় হয় কোন সে আগন্তুক?"
বৈচিত্র্যময় ১১টি গল্প নিয়ে সাজানো মাত্র ৯৬ পৃষ্ঠার গল্পগ্রন্থটি ওয়াসি আহমেদের প্রথম গল্পসংকলন। শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাসের কবিতার পঙক্তি গল্পের শিরোনাম হিসেবে বাছাই করে নেয়ার পেছনেও যেন লেখকের স্বপ্রণোদিত উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে। আর তাই গল্পের শিরোনামগুলো - সংক্ষোভ, জীবনের এইসব নিভৃত কুহক, একজন ব্যধিগ্রস্ত মানুষ, কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল, বিকৃতি, জ্বরের দিনগুলোতে এক কাল্পনিক নগরীর মিথ্যা উপাখ্যান, সাতটি তারার তিমির, অবান্তর অথচ অকাট্য, চক্র, নিয়তি এবং তিনটি বাজে গল্প।
প্রথম গল্পগ্রন্থ হলেও গল্পগুলো যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে অতীব উজ্জ্বল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পাঠক যেন গ্রন্থটি পড়া শেষে বিন্দুমাত্র অনুশোচনায় না ভুগে সেই চেষ্টার ছাপ স্পষ্ট লেখকের লেখনশৈলী আর বর্ণনাভঙ্গিতে। গল্পের পটভূমি ভালো লাগতেই হবে এমন ধারণায় বদ্ধমূল না থেকে, বরং লেখক গল্পের পটভূমিটাকে নিজস্ব ভঙ্গিমায় উপস্থাপনে জোর চেষ্টা চালিয়েছেন। আর এই ব্যাপারটাই পাঠকের কাছে দারুণ উপভোগ্য মনে হবে।
পৃথিবীতে এমন কিছু জিনিস আছে, যেগুলোকে যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়াই একসাথে পাবার নির্দোষ প্রত্যাশা করা হয়। অন্ধকারের সাথে নৈঃশব্দ্যের উপস্থিতি ঠিক তেমনই একটা ব্যাপার। অবশ্য প্রত্যাশার সঙ্গে সবসময় বাস্তবের মিল থাকে না, সে কথাটাও সত্য। - ও��়াসি আহমেদ চেষ্টা আর ত্রুটিতে আবদ্ধ না থেকে বরং গল্পের ভুবন পরিভ্রমণে বের হওয়া যাক এবার। শুরুতেই আসে সংক্ষোভ নামক গল্পটি। গল্পটা এক দম্পতির। খানিকটা পশ ধাঁচের উচ্চ-মধ্যবিত্ত দম্পতির ঘরে ইতিমধ্যেই ছোটাছুটি করে তাদের একমাত্র কন্যা সন্তান। তাসত্ত্বেও ঘর আলোকিত করে আরেক ফুটফুটে শিশু। বাবা-মা’র সমান পাল্লায় বাটা আদর যেন তখন উনিশ-বিশ হয়ে উঠে সন্তানের চোখেই। শিশুদের মনস্তত্ব নিয়ে লেখা সংক্ষোভ গল্পটা লেখকের পেশার পরিচয়ের পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গাটাকেও যেন সূক্ষ্ম এক আঘাত হানে। গল্পটা আদতে তরুণ দম্পতির সুখের পরিমাপ নিয়ে শুরু হলেও, শেষটা ধক করে এসে গলার কাছে মাছের কাঁটার মতো অসাবধানতায় আঁটকে যায়।
জীবনের এইসব নিভৃত কুহক নামক গল্পটি যেন পারিপার্শ্বিক জীবনের অন্তরালে রয়ে যাওয়া বাস্তবিক সত্যের এক কল্পিত উপস্থাপন মাত্র। খাঁচায় বন্দী এক মধ্যবয়সী গৃহিণীর একাকীত্বের সঙ্গী হওয়া মানুষগুলো, পারিপার্শ্বিকতা এবং মুহূর্তগুলো ফুটে উঠেছে যেন গল্প নামক এক দুঃখী কবিতার আত্মায়। শৈশবের একাকীত্ব, কৈশোরের ক্ষোভ আর বিপণ্ণ যৌবনের দগ্ধতাকে সঙ্গী করে ফেরা এক আর্টিস্টের গল্প একজন ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ। নার্সিসিজমের চরম মাত্রায় পৌঁছেও সহজাত প্রবৃত্তির বশে যার মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে - বিশ্বাস কর, আমি এরকম হতে চাইনি…!!
নীলক্ষেতে এক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় আটকে পড়া চার যুবক এক বৃদ্ধের মুখে শুনে হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাস। নীলক্ষেতের বদ্ধ চার দেয়ালের দোকান থেকে বৃদ্ধ তাদের নিয়ে যায় চর্যাপদের আদি কবি লুইপার রহস্যময় জীবনে। গল্পটি যে ইতিহাস নির্ভার আর অসাধারণ তথ্যবহুল তা যেন গল্পের নামেই প্রকাশ পায় - কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল।
বিকৃতি গল্পটি এক যুবকের। সেই যুবক একদিন গ্রামে গিয়ে এক ভণ্ড কবিরাজের সন্ধান পায়। চিকিৎসার অভাবে মৃতপ্রায় তার মেয়ের জন্য মায়া জাগে তার মনের উপরিতলে। একইভাবে আবার মনের ভূতলে সদা জেগে আছে প্রেমিকার খুশী আর সমাজের চোখে তথাকথিত ব্যক্তিত্ব প্রকাশের সুযোগের সদ্ব্যবহার। ভিন্ন জগতের দুই বাসিন্দার অভিন্ন বিকৃত মানসিকতার পরিচয়টাই মেলে ধরেছেন লেখক এই গল্পে।
দৃষ্টি থাকলেই এই না যে চোখ মেলে সবকিছু দেখতে হবে। ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে না জানলে এই শহরে টিকে থাকা কঠিন। - ওয়াসি আহমেদ
শহর জুড়ে জ্বরের আধিপত্য। সেই অবিরাম জ্বরের দিনগুলোতেই শহরে এসে হাজির হয় এক আগন্তুক। যাকে অনেকেই চেনে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা নামে। জ্বরের উপসর্গ দৃশ্যমান; জ্বর তাড়াতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আগন্তুক; কিন্তু শহরের অভিভাবক যে সেই পুরনো গল্পেরই নগরপিতা - তা যেন বেমালুল ভুলে গিয়েছিল আগন্তুক।
সাত একটি অদ্ভুত সংখ্যা। কেননা, নরক, মহাপাপ, রংধনু, দিন এবং মহাদেশের সংখ্যা সাত। একইসঙ্গে সৌভাগ্য আর দুর্ভাগ্যের প্রতীক সাত। এরকমই সাত সংখ্যায় নির্ভর করে সাত বছর আগেকার এক গল্প রচিত হয়েছে সাতটি তারার তিমির শিরোনামে। সম্পর্কের জটিলতা, সঙ্গী হারানোর বেদনা, বিষণ্ণতা, বিষাদের সুর আর একাকীত্বের দর্শনগুলো যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে রোমান্টিকতার গহিনে।
ভালোবাসা ব্যাপারটাকে মেয়েরা খুব সহজেই আঁচ করতে পারে। সৃষ্টিকর্তা এই বোধশক্তিকে উপহার হিসেবে দিয়েছে ওদের। - ওয়াসি আহমেদ
জহিরের মৃত্যু খবরটা বয়ে নিয়ে আসে একদল কাক। এনে সেই খবর দেয় মৃত্যু নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকা আবদুল মোত্তালেবকে। দুজনের মৃত্যু কারণ ভিন্ন হলেও দুজনের সত্ত্বায় এক অভিন্ন সুতোর টান। আর সেই টানের ব্যাখ্যাটা অবান্তর অথচ অকাট্য - যেমন গল্পের শিরোনাম। আধিভৌতিক নাকি পরাবাস্তব এমনকি এক দু��্টচক্রে আবদ্ধ স্বয়ং চক্র গল্প। জাহিনের জীবনটা অতীব কষ্টের। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে জী��নের প্রতিটা ক্ষেত্রে অদ্ভুত এক কষ্ট তাকে চারিদিক থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। তবে এসবকিছুর উর্ধ্বে যে তার জীবনটা এক দুষ্টচক্রে আবদ্ধ তা কি জাহিন জানে?
নিয়তি গল্পটা তিনজন মানুষের নিয়তিকেই কেন্দ্র করে রচিত। আসগর রশীদ সম্পত্তির পাহাড়ের উপর বসে সুখের সংসার রেখে যায় ক্ষণিক বিনোদনের গহিনে। ত্রিমুখি এই জীবনযাপনে অভ্যস্ত আসগর রশীদকে অনভ্যস্ত করতে কেউ একজন আসে ব্ল্যাকমেইল করার ছলে। অপরের জন্য খোঁড়া কুয়ায় নিজেকেই পড়তে হয় যদি না নিজের উদ্দেশ্য মহৎ না হয়।
আর সবশেষে রয়ে যায় তিনটি বাজে গল্প। প্রতীকী গল্পের ছলে বলা এই কল্পকাহিনীগুলো ভাবনার খোরাক যোগায়। আদিমতার উত্থান, প্রকৃতির ভারসাম্য এবং নির্মম বাস্তবতার সত্যতা প্রকাশ যেন গল্পগুলো্র অন্তরাল থেকে মাথা উঁচু করে উঁকি দেয় পাঠকের উদ্দেশ্যে।
ওয়াসি আহমেদ। তবে তাকে ওয়াসি আহমেদ রাফি নামেই বেশ ভালোভাবে চেনা যাবে। কেননা, ওয়াসি আহমেদ নামে আরো একজন লেখক রয়েছেন আমাদের সাহিত্য প্রাঙ্গণে। পেশায় ডাক্তার অথচ একমাত্র নেশা বই সংগ্রহ করা এবং বই পড়া। পাশাপাশি গান-বাজনা আর ফটোগ্রাফির ঝোঁক আছে। তবে সেটা বই সংগ্রহ আর পড়ার মতো নেশায় রূপান্তর হতে পারেনি। কথিত আছে, ওয়াসি আহমেদ রাফির ঘরে কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ হাজার বই মজুত আছে। সেই যাই হোক, প্রতিবছর গুডরিডসে ২০০-২৫০ বই পড়ার চ্যালেঞ্জ সফলভাবে সম্পন্ন করা পাঠকের ঘরের অবস্থা তেমনই হবার কথা।
ওয়াসি আহমেদ রাফি সমসাময়িক সাহিত্য অঙ্গনে পরিচিত নাম একজন পড়ুয়া পাঠক এবং সফল অনুবাদক হিসেবে। এমনকি প্রথম মৌলিক উপন্যাস “আঁধারের গহীন নিরুদ্দেশে” অর্জন করেছেন পাঠকপ্রিয়তা তরূন পাঠকদের কাছে। দ্বিতীয় উপন্যাস “চমৎকার ধরা যাক দু’-একটা ইঁদুর এবার” শীঘ্রই প্রকাশিতব্য। “যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার” তার প্রথম গল্প সংকলন।
এমন একটা প্রবাদ বাক্য আছে- পুরোদস্তুর একজন লেখক হয়ে ওঠার আগে একজন পুরোদস্তুর পাঠক হতে হয়। কেননা, এতে করে লেখক সহজেই বুঝে নিতে পারে পাঠক কি চায় বা কতটুকু লেখকের কাছ থেকে প্রত্যাশা করতে পারে। যদিও ব্যাপারটা কেবলই একটা অনুমানের ভিত্তিতে পূর্ণ। যাকগে, ওয়াসি আহমেদ যে পুরোদস্তুর একজন পাঠক তা ন্যে ফলাও করে বলার কিছু নেই। তবে পুরোদস্তুর একজন লেখক না হলেও ওয়াসি সেই পথেই যে হাঁটছে তার প্রমাণ এই গল্পগ্রন্থ। তার লেখনশৈলীর বৈশিষ্ট্য এবং স্বতন্ত্রতা ইতিমধ্যেই তার প্রথম মৌলিক উপন্যাসকেও অতিক্রম করে গিয়েছে।
ওয়াসির লেখনশৈলীতে এক রকমের সূক্ষ্ম ধার আছে। যা গল্পের কোমলতাকে পাঠকের হৃদয় স্পর্শের চেষ্টা করে যেমন; ঠিক তেমনই পাঠককে ধাক্কা দেয় গল্পের রুক্ষতায় লেখনশৈলীর কঠিনতায় বাস্তবের নির্মমতাকে উপস্থাপনের অন্তে। ভিন্ন গল্প নিয়ে সাজানো সংকলনের একটা অভিন্ন বৈশিষ্ট্য অবশ্যই আলোচ্য। আর তা হচ্ছে, গল্পের চরিত্রায়ন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লেখকরা তাদের সৃষ্ট চরিত্র নিয়ে এন্তার গবেষণা করে থাকেন। নিজের সৃষ্ট চরিত্রটাকে একটু ভিন্নভাবে প্রতিস্থাপনের লক্ষ্যেই তা করে থাকেন।
কিন্তু ওয়াসির চরিত্রগুলো বেশ স্বতঃফূর্ত আর প্রাণবন্ত। চরিত্রগুলোই এমন যে মনে হয় - “আরেহ গতকালই তো জাহিনকে দেখলাম ধানমন্ডি লেকের পাড়ে বসে সিগারেট ফুঁকছে” অথবা “নীলক্ষেতের সেই ঘুপচি গলির চায়ের দোকানের পেটমোটা বেড়ালটা সেদিনই এসে পায়ের সঙ্গে শরীর ঘষটে আদর চাইল”।
খুবই পরিচিত চরিত্রগুলোকে এনে দাঁড় করিয়েছে ওয়াসি তার গল্পের প্রাঙ্গণে। অথচ এতটা পরিচিত চরিত্রই অপরিচিত লাগে গল্পের অলি-গলিতে। কেননা, সেসব চরিত্র স্বতন্ত্র। তাদেরকে অন্য কোনো গল্পের দেখা যায়নি ইতোপূর্বে। তবে তাদের সন্ধান পাবে পাঠক বাস্তবে। ওয়াসির চরিত্রগুলো তাই বাস্তবিকতার সুরেই কথার মালা জপে, কাল্পনিকতার আশ্রয়ে নয়।
আর তাই হয়তো চরিত্রের পাশাপাশি লেখক হিসেবে নিজেকে নিজের কাছে রেখেছেন সৎ। সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে লেখকের দায়িত্ব থাকে সামগ্রিক প্রেক্ষাপটের বর্তমান চিত্রের বর্ণনা। যেটা তিনি করেছেন অনায়াসেই গল্পের মধ্যে ডুবে গিয়ে। যেন সেই বার্তাটা গল্পের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। অবিরাম মৃত্যুর দিনগুলোতে কাল্পনিক এক আগন্তুকের আগমন ঘটিয়েছেন শহরের রাজপথে। বিশ্লেষণ করেছেন বর্তমান প্রেক্ষাপট।
আবার, বলে গেছেন মানুষের চিরাচরিত স্বভাবের কথা। পশ্চাৎদেশের ন্যায় দ্বিখণ্ডিত আবেগের কথা। অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে উচ্চবাক্য করা যায় ঠিকই; কিন্তু সেসবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া যায় না। তার চাইতে বরং ব্যাপারটাকে ভুলে যাওয়াটাই চিরাচরিত নিয়মের ঐতিহ্যে পর্যবসিত হয়। সেসবই কথাই লেখক মনে করিয়ে দেয় এমন বাক্যে -
“চৈত্রের শুরুতে কালবৈশাখী বলে-কয়ে আসে না। প্রতিবছর একই কান্ড ঘটে, তবু আমরা ভুলে যাই। ঠিক যেভাবে আমরা ভুলে যাই দেশের বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিকান্ড, খুন, ধর্ষণ কিংবা জালিয়াতির কথা। ভুলে গিয়ে হয়তো আমরা শান্তি পেতে চাই,চাই অস্থিরতা দূর করতে। নিজেকে বোঝাই, ভালো আছি। এই ভুলে যাওয়া আমাদের মজ্জাগত স্বভাব।”
চরিত্রের পাশাপাশি আরেকটা বিষয় পাঠককে ভাবাবে - গল্পের প্রেক্ষাপট। চেনা গলি, জানা পরিবেশ ধরে হেঁটে চলে গল্প। যেন পাড়ার মোড়ের কোনো টংয়ে বসে কারো মুখ থেকে গল্প শোনা। আর ঠিক সেই চেনা গল্পেই জোর করে মিশে যায় অচেনা অতিপ্রাকৃত বা পরাবাস্তব কোনো উপাদান। অথচ বাস্তব আর পরাবাস্তবের এই দোলাচাল মুহূর্তে মিলিয়ে যায় গল্পে; যেমনটা চিনি নিমিষেই মিলিয়ে যায় গরম লিকারে।
একমাত্র মানুষই তো পারে আরেকজন মানুষকে আপন করে নিতে। - ওয়াসি আহমেদ
অথচ তা সত্ত্বেও, পাঠকরা এই গল্পগ্রন্থ পড়াকালীন সময়ে অনিচ্ছায় বা অসতর্কতার বশতে গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জিভে ছ্যাঁক খাওয়ার মতো অসন্তুষ্ট হতে পারে। অথবা মিষ্টি ভেবে চুমুক দিয়ে তিক্ততার অনুভূতিতেও পর্যবসিত হতে পারে। কেননা, কয়েকটা গল্প খুব বেশি চেনা, খুব বেশি জানা, খুব বেশি অনুমেয়। আবার কোনো কোনোটা নিতান্তই সাধারণ পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকে। এমতাবস্থায় পাঠকের বিরক্তির উদ্রেক ঘটে।
কেননা, যাহা পাঠকের কাছে বোধগম্য নহে তাহাই তার নিকট বিরক্তির কারণই বটে। আবার, যাদের লেখায় পাঠক হিসেবে বিচরণ করেছেন লেখক। তাদের লেখার ধাঁচটা হয়তো হাতের অপরিপক্বতার কারণেই ছুটে এসে ভিমড়ি খেয়ে পড়ে লেখকের লেখনশৈলীর নিজস্বতা আর স্বতন্ত্রতার ভিড়ে।
তবে ভালো লাগা আর খারাপ লাগার নিক্তিতে দুই দিকের পাল্লাই পাঠকের কাছে সমান বলে মনে হবে। কেননা, লেখকের গল্প, গল্পগুলোর চরিত্র আর পটভূমি হারিয়ে যায় লেখকেরই লেখনশৈলীর বুনোটে। একটা করে বাছাই করা শব্দ চয়ন করে বাক্য গঠন করেছেন সাবলীলতা আর প্রাঞ্জলতার সুরে। তার বর্ণন��ভঙ্গির জাদুময়তার কাছে সাধারণ গল্পই পায় অসাধারণের তকমা। একইসঙ্গে এ যেন লেখকের লেখক হবার পূর্বপ্রস্তুতির কথা জানান দেয়। অপরিপক্ব হাতের এমন ভাষার গাঁথুনি যেন আসন্ন ভবিষ্যতের পরিপক্ব লেখকের ইঙ্গিত ছুঁড়ে দেয় পাঠকের দিকে।
অতএব এতক্ষণে হয়তো তা পরিষ্কার। তাই লেখকের প্রতি রইলো তাই অঢেল শুভকামনা।
বই: যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার (গল্পগ্রন্থ) লেখক: ওয়াসি আহমেদ প্রচ্ছদ: সজল চৌধুরী প্রকাশক: অবসর প্রকাশনা সংস্থা পৃষ্ঠা: ৯৫ মলাট মূল্য: ১৮০/- টাকা মাত্র
Recently, I have been a fan of short stories, specially written by contemporary writers of Bangladesh in this new era. I buy anything and everything I can land my hands on if my wallet permits. Sometimes the books disappoint and sometimes they rejoice by themselves through sheer magic of words and imagination portrayed by the writers. This book, which is a comprised of 11 short stories, was a sweet escape from several other badly written books. The stories are originals and each one of them offered a new genre from the other ones. I will just lay out my personal experiences which I accumulated as I finished this book in one sitting. Yes, it was not a dull book.
The first story called “সংক্ষোভ” is based on gore. Though, it starts off with a sweet serene feeling with no implications of what is coming next, the ending might shake up your heart a bit. There is no blood splattering around in this one, but it will make you clutch your heart, even for a nano second. If you like your steaks medium rare, this might change your appetence forever. The second one “জীবনের এইসব নিভৃত কূহক” is a very short story of loneliness, despair penned in a very poetic manner. At the end of it, you either feel the void that Rabeya’s heart is filled with or you just simply forget and move on. Third one “একজন ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ” is a depiction of the mind of an artist. Or is he? Our society is unfortunately full of human beings who suffer from severe psychological issues who continue to live their whole lives untreated and mostly misunderstood/abused. Though, most of them are harmless for the general people around them, not all are what they seem to be. Be careful to misuse, mistreat the unfortunates around you. You do not know what is lurking deep down in their souls. Fourth one is called “কা আ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল” । It’s a story of couple of old friends hanging out after work who get stuck in a sudden blast of unannounced heavy rainfall. They meet an older man that evening along with a fat cat lurking around them for shelter. Chit chats about a mythological tree starts among them and then the story unfolds. Interested yet? You should be! Fifth one is “বিকৃতি” is a story of not self-realization but the opposite. You must dive in it to decipher it. And when you do, trust me, you will not like yourself that much anymore. I guarantee. Sixth is “জ্বর এর দিন গুলোতে এক কাল্পনিক নগরীর মিথ্যা উপাখ্যান” This story reminded me of the recent corona virus attack and the morbid denial we are all in this world. It is simply getting harder to breathe, to love and to live. The languishing tale of the comeback of the pied piper of Hamelin will leave the reader full of sighs.
Seventh one is “সাতটি তারার তিমির” Is a melancholic love story. Poetic justice is intertwined in most parts. It will leave the reader forlorn, but life goes on. Does it not?
Eight is “অবান্তর অথচ অকাট্য” This story absolutely made me reminisce about Jibonanondo Das’s poetries. The symbolism, the metaphors, the sadness which engulfed the whole layout of this story would have made Jibon Babu very happy I believe. Kudos to the writer for penning it down flawlessly. Ninth is “চক্র” This is a total captivating short one based on magic realism. It’s a story of Jahin, a boy whose last night of being alive is penned down mercilessly. But then again, in another time or sphere, it might be happening again. Tenth is “নিয়তি” This one is not a fully original one from the writer, but it is inspired by a foreign story. Fate can be wondrous as it can be mysteriously deadly. You must read it to find it. You will not be disappointed. Eleventh one is “তিনটি বাজে গল্প” The last one amused me; it tickled my fancy. Specially the second one of the three very short stories, or should I say it can all be comprised of one? Surrealistic approach through wordings created a niche for the writer for this one for sure. Makes you crave for more. So, when are we getting some more? We shall be waiting.
শুরুতেই জানিয়ে রাখা ভালো, এটি লেখক ওয়াসি আহমেদের প্রথম গল্প সংকলন। মোট এগারোটি ছোটগল্প দিয়ে বইটিকে সাজানো হয়েছে। হালকা-পাতলা গড়নের এই ছিয়ানব্বই পৃষ্ঠার বইটিকে অন্য এক মাত্রা এনে দিয়েছে সজল চৌধুরীর প্রচ্ছদ। প্রচ্ছদের এপিঠ ওপিঠ দেখলেই পাঠকগণ মনস্তত্ত্বজনিত আগাম সতর্কবার্তা পেয়ে যাবেন; প্রকৃতপক্ষে গল্পগুলো পাঠকের মনস্তত্ত্বের পক্ষে খুব আরামদায়ক হবে না, গভীরভাবে ভাবাবে। প্রতিটি গল্প নিয়ে আলাদা করে বলার চেয়ে গল্পগুলোর ভাবগত মিল খুঁজে উপস্থাপন করাটাই বেশি কাজে দেবে। অধিকাংশ গল্পই পাঠকের মনস্তত্ত্বকে নাড়া দেবে। কিছু গল্প সরাসরিভাবে সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারের কাতারে পড়ে। ছোটগল্পের অবয়বে সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারের আমেজ নিয়ে আসার প্রচেষ্টা রীতিমতো দুঃসাহসিক কাজ নতুন লেখকের ক্ষেত্রে। ওয়াসি আহমেদ আমার বিচারে এদিক থেকে সফল�� প্রেমেন্দ্র মিত্রের সিংহভাগ ছোটগল্পে যেমন দুঃখবাদের প্রকট ছায়া দেখা যায়, এই বইয়ের বেশ কিছু গল্পে তেমনই লেখকের ব্যক্তিগত দর্শনের জোরালো প্রকাশ পাঠকের দৃষ্টি এড়াবে না। গল্পগুলোতে ঘুরেফিরে প্রেম আছে, দৈনন্দিন একঘেয়ে জীবনের পৌনঃপুনিকতা আছে, সাথে দর্শন, সাহিত্য, পৌরাণিক বিষয়ও আছে। গল্পের নামকরণের ক্ষেত্রে কবি জীবনানন্দ দাশের বিভিন্ন কবিতার লাইনকে আশ্রয় করা হয়েছে। আর বইয়ের নামকরণও করা হয়েছে রেনেগী কাদুর একটি কবিতার অনুবাদ থেকে, যেটি অন��ব��দ করেছেন স্বয়ং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
গল্প সংকলনের রিভিউ লেখার ক্ষেত্রে আমি কখনোই আলাদা করে প্রতিটি গল্প নিয়ে লিখি না। ছোটগল্পের আলাদা করে রিভিউ লেখাটা আসলে সম্ভবও না, স্পয়লার হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। এই চমৎকার বইটির স্পয়লার লিখে আমি পাপ করতে রাজি নই একেবারেই।
সাহিত্যের আঙ্গিকতত্ত্বের বিচারে বইটির ছোটগল্পগুলো কতটা সফল সে বিচারে যাওয়ার পথ লেখক বইয়ের শুরুতেই বন্ধ করে দিয়েছেন। সূচিপত্রেরও আগে ''গল্পের শুরুতে-" শিরোনামে যে শোয়া এক পৃষ্ঠার জবাবদিহিতা লেখক করে রেখেছেন বইটিতে, সেটি পড়ে পাঠকগণ লেখকের জ্ঞানের পরিধির প্রমাণ যদি নাও পান, তার কৌশলী শব্দচয়নের দৃষ্টান্ত নিশ্চয়ই পাবেন। এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়, ওয়াসি আহমেদের প্রকাশভঙ্গি সাবলীল, আকর্ষণীয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে রীতিমতো মনোমুগ্ধকর। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য দুর্বোধ্য দার্শনিকতা পাঠকের মাথার ওপর দিয়ে চলে যাবে!
আগাগোড়া বইটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। অকালপক্ব কিশোর পাঠকগণের এই গল্পের ধারাগুলো বুঝতেই ঘাম ছুটে যাবে, কাজেই তাদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা জাফর ইকবাল স্যারের কাছেই আপাতত ফিরে যান।
সবমিলিয়ে বইটি খুব অল্প সময়ের মধ্যে এক বসাতে শেষ করার মতোন। রিডার ব্লক ছাড়ানোর ক্ষেত্রেও একটি ভালো পরামর্শ হতে পারে বইটি। টাকা দিয়ে এটি কিনে অন্তত আফসোস হবে না। শুভকামনা লেখকের জন্য।
চমৎকার লিখনশৈলী। জ্বরের দিনে এক কাল্পনিক নগরের মিথ্যা উপাখ্যান সবচেয়ে ভালো লেগেছে। প্রায় প্রতিটা গল্পই মোটামুটি ভালো। সংক্ষোভ, একজন ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ, নিয়তি, বিকৃতি এই চারটি বেশি ভালো লেগেছে।
আসুন সদ্য প্রকাশিত বই 'যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার ' নিয়ে হালকা আলোচনা করা যাক। বইটি গতকালই কেবল প্রকাশিত হয়েছে অবসর প্রকাশনার ব্যানারে।
বইটি লিখেছেন বর্তমানের শক্তিমান লেখক ডা. ওয়াসি আহমেদ- ভাই।
বইটির প্রচ্ছদ করেছেন সজল চৌধুরী, বেশ অদ্ভুত রকমের প্রচ্ছদ, নিচের দিকে দু'টো মাছ একে অপরের রুপ দর্শনে ব্যস্ত - এই কনসেপ্টটা ভালো লেগেছে, সজল চৌধ���রীর প্রশংসা করতেই হয়।
বইটির মুদ্রিত মূল্য ১৮০ টাকা।
বইটি মেলা থেকে কিনতে চাইলে ফুট করে প্যাভিলিয়ন ১৩ তে চলে যাবেন।
যাহোক, আলোচনা শুরুর আগে কিছু কথা বলে নেই।
বইটি মূলত ছোট গল্পের সংকলন।
এর প্রতিটি গল্প আমাকে ভিন্ন স্বাদ দিয়েছে।
কোথাও সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারের স্বাদ পে���়েছি, কোথাও নিরেট সিরিয়াল কিলারের সুদীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস আমাকে মোহগ্রস্ত করেছে, কোথাও ফ���যান্টাসি হরর জনরার গল্প- মন কে এতোটাই ছুঁয়ে দিয়েছে যে আমি কনফিউজড হয়েছি, আসলে কি এমন ঘটনা সত্যিই অতীতে ঘটেছিল?
কোন কোন গল্পকে আমি জনরা হিসেবে চিহ্নিত করতে পারিনি। তবে সেগুলোর জন্যে 'মাইন্ড ফাকিং' নামক নতুন একটি জনরার উদ্ভাবন ঘটানো যেতে পারে। কারণ, সেগুলো আসলেই আপনার মানস্পট-কে ছিঁড়েখুঁড়ে এফোঁড়ওফোঁড় করে বেরিয়ে আসবে।
চলুন আর কথা না বাড়িয়ে সংক্ষেপে গল্পগুলোর সাথে কিছুটা পরিচিত হই!
প্রথম গল্প-টির নাম সংক্ষোভ!
এই গল্পটির লেখনির আর কাহিনি সংক্ষেপ-কে কোন ভাবেই এডগার এলান পো কিংবা দফনে দু মরিয়ে-র লেখা থ্রিলার গুলো থেকে পিছিয়ে আছে বলা যাবে না!
চাইল্ড সাইকোলজি নিয়ে এতো পারফেক্ট থ্রিলার শর্ট স্টোরি বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি নেই, তা বলতে পারি!
ছোট সাজানো চার জনের একটি ছিমছাম সংসার! কর্তার নাম ফরহাদ, দু সন্তানের একজন নুসরাত আরেকজন নুহিন!
তাদের বাবা ফরহাদের মাথায় বেশ অদ্ভুত খেয়াল চেপে বসে মাঝে মাঝে, সে খেয়ালের বসেই নানান জিনিস কিনে আনে বাসায়...।
আর তা নিয়েই পূর্ণতা পায় একটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের চাইল্ড সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার!
ছোট গল্প বেশি বর্ণনা করতে নেই।
এরপরের গল্পটির নাম 'জীবনের এইসব নিভৃত কুহক'!
এই গল্প-টি আমি খুব বেশি উপভোগ করি নি। ইদানিং, হরর, সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার এইসব ছাড়া কেন জানি কিছু উপভোগ করতে পারি না। তাই বলা যায় দোষ-টা আমার। গল্পের নয়।
গল্পের একদম শেষে কোন এক অসহায় গৃহিণীর হারানো স্মৃতির তীব্রতর হাহাকার আমাকে এক ফোঁটাও নাড়িয়ে দেয় নি, তা বললে অবশ্যই মিথ্যে বলা হয়!
সেই মৃদু কম্পন-কে শক্তি চট্টোপাধ্যায় আরো একটু বাড়িয়ে দিয়েছিলেন কি?
'হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়..'- কি অদ্ভুত সাধারণ শক্তিশালী এই পংক্তি! কি অদ্ভুত এর সাথে মিশে থাকা অনুভূতি....!
'একজন ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ '- তিন নম্বর গল্পটির নাম!
এ গল্পটির প্রতিটি শব্দই আমি উপভোগ করেছি।
মাঝে মাঝে খুন করতে হয়?..খুন করা বেশ প্রয়োজন হয়ে পড়ে?..নাকি তোমাদের এই সমাজ, তোমাদের অবিচারের বুননে ভরা লোভি কাপুরুষোচিত শৃঙ্খল বাধ্য করে খুন গুলো করতে?
খুন করা বড্ড পাপ, তোমরা যখন তোমাদের কপট মিথ্যে স্বার্থ মেশানো ভালোবাসায় ঘেরা নিষ্ঠুরতা নিয়ে কোন চালচুলোহীন যুবক-কে দুঃখ সাগরের ভেলায় ভাসিয়ে দাও, পাপ কি তখন হয় না?
নিষ্ঠুরতম খুনির বুকেও হাহাকার থাকে, কিন্তু সেই হাহাকার কেও শুনতে পায় না... সেই হাহাকার শোনার জন্যে তোমাদের পৃথিবী আজো প্রস্তুত নয়!
কখনো হয়তো প্রস্তুত হবেও না!
পরের গল্পটির নাম 'কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল' -
দেশের অনেক রথী মহারথী লেখকগণ এই গল্পটির প্রশংসা করেছে। এটি ছাপার অক্ষরে আগেও এসেছিল অন্য রঙের একটি ব্যানারে। এই গল্পটি নিয়ে আলোচনার কি আদৌ প্রয়োজন আছে??
এটি মূলত ফ্যান্টাসি হরর জনরার তথ্যবহুল একটি গল্প। হারানো ইতিহাসের অনেক কিছুই গল্পের ছলে লেখক তুলে এনেছেন, সেই বজ্রযোগীদের কথা, চর্যাপদ, লুই পা বা সবর পা- তাঁদের নিয়ে লেখা একটি গল্প!
ফ্যান্টাসি হরর হলেও লেখনীর দরুন পাঠক শেষ পর্যন্ত বেশ বিভ্রান্ত হবেন বলেই আমার ধারণা।
অনেকেই আপন মনে ভেবে নিবেন, এমন- টা কি সত্যিই ঘটেছিল?!
গল্পটির বর্ণনায় যে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ মানস্পটে ফুটে উঠবে তা আসলেই মুগ্ধকর!
আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, সবগুলো গল্পের মাঝে একটি গল্প সাজেস্ট করুন, যার জন্যে 'যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার'- বইটি কেনা প্রয়োজন, তবে আমি বলবো গল্পটির নাম 'বিকৃতি'!
This one story has really given me a goosebump!
গল্পটি আধুনিক ফেসবুক সভ্যতার একটি নিষ্ঠুর বাস্তবতা তুলে ধরেছে।
একজন দরিদ্র কবিরাজ আর একজন আধুনিক ফিটফাট ধূর্ত তরুণের গল্প এটি! অমানবিক এক নিরেট নিষ্ঠুরতার গল্প এটি! অন্তরাত্মায় এক অসাড় শীতলতা-কে জাগিয়ে তোলার গল্প এটি!
এই গল্পটি পড়তে পড়তে হঠাৎ আমার মনে হয়েছিল, আমি বুঝি সাহিত্য সম্রাট হুমায়ূন আহমেদ সাহেবের লেখা কোন গল্প পড়ছি। Outstanding effort indeed!
এবার যদি জিজ্ঞেস করা হয়, গল্পের কথা বাদ দিন, সবচেয়ে স্পর্শকাতর উক্তি-টি বলুন এই বই থেকে! চোখ বন্ধ করে বলে দিবো, "ক এলাকায় এক বাস ড্রাইভার এক মধ্যবয়স্ক শিক্ষককে বাসচাপা দিয়েছে; খ মহল্লায় ধর্ষিত হয়েছে সাত বছরের এক শিশু; গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাতের বেলা এক ছাত্রকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে কারা যেন"- উক্তিটির কথা!
গল্পটি একটি কাল্পনিক দেশ এর কাল্পনিক শহর- কে নিয়ে লেখা, যে কাল্পনিক দেশের নগরভবনের এক ক্ষমতাশালী পুরুষ ফুট করে বলে দিয়েছিলেন, উত্তরে মশার ওসুধ ছিলাটে মশা দক্ষিণে যায়!
এই উক্তির সাথে আমাদের দেশীয় কারো মিল পাওয়া গেলে সেটা অবশ্য কাকতালীয় ব্যাপার মাত্র, তবে হ্যাঁ আমাদের পলিটেশিয়ান-দের জোর করে হলেও গল্পটি পড়ানো উচিৎ। তাদের এই গল্প থেকে শিক্ষা নেয়া জরুরি।
গল্পের শেষে এক অসহায় তরুণের সাথে দেশের হাজার লাখো শত সহস্র তরুণের মিল পাওয়া যায়, যারা দেশের জন্যে কাজ করতে চায়। কিন্তু, তারা কিছুই করতে পারে না। কারণ, দেশ তাদের আগলে রাখতে চাইলেও, এদেশের রাজনৈতিক মহারথীরা তাদের লাথি মেরে তাড়িয়ে দেয়...!
'অবান্তর অথচ অকাট্য' - গল্পটি মাইন্ড ফাকিং জনরার একটি গল্প। কঠিন গম্ভীর ভাষায় গল্পটি বর্ণিত, যা আপনার চিন্তাভাবনাকে একটু হলেও ঘেঁটেঘুঁটে অসাড় বানিয়ে দেবে! খুলি ভাঙ্গার শব্দ থেকে একটি আত্মহত্যার গল্পটি চেতনায় কেমন যেন দাগ কাটে। ভালোমন্দ অনুভূতিহীন একটা দাগ!
এবার চলুন একটা অসাধারণ ব্ল্যাকমেইলিং থ্রিলারের সাথে পরিচিত হই। এর নাম - 'নিয়তি!' বেশ ভালো একটা থ্রিলার, I must and must say! ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আসগর সাহেব সাজানো গুছানো একটা জীবনের বাইরেও লুকিয়ে উপভোগ করছিলেন এক রক্ষিতা-কে। যার ব্যাপারে দ্বিতীয় কোন মানুষ জানতো না। এক সকালে সেই রক্ষিতাকেই নিয়ে শুরু হয় ব্ল্যাকমেইলিং। সপ্তাহের পর সপ্তাহ টাকা দিয়ে গেলেন। কিন্তু ধমকি আর বন্ধ হয় না! কে করছে এই কাজ? কিভাবে রক্ষা পাবেন আসগর সাহেব? তার পরিণতি কি? একটা ভালো শর্টফিল্ম সহজেই হয়ে যায় গল্পটি দিয়ে।
চক্র গল্পটিকে মোটামুটি বলা চলে আমার দৃষ্টিকোণ থেকে। মিস্ট্রি জনরার একটি গল্প। তবে গল্পের ভাষা- শৈলী প্রশংসনীয়।
সবশেষে, "তিনটি বাজে গল্প"- শিরোনামের দুটি গল্প ভালো লাগে নি, কারণ এগুলোর মাথামুণ্ডু কিছু বুঝি নি। এগুলো আমার কাছে সালভাদর দালি'র পেইন্টিং গুলোর মতোই, দুর্বোধ্য। যা বুঝি নি তাকে নিয়ে মন্তব্য কি করবো? তবে এই তিনটির মাঝে দুই নম্বর গল্পটি বেশ চমৎকার! বেশ একটা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করবে পাঠক-কে তা আন্দাজ করা যায়! বইটি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মতো বই, আবার চাইলে ধীরে সুস্থে এই বইকে অনুধাবন-ও করা যায়! এটি তেমনিই একটি বই!
সর্বোপরি, আঁধারের গহীন নিরুদ্দেশের দ্বিতীয় কিস্তি আর ইঁদুর ধরার উপন্যাস-গুলোর জন্যে অপেক্ষা করছি!
ওয়াসি আহমেদ 'এর গল্প সাজানোর দক্ষতা এবং বাংলা ভাষার ব্যবহারে ক্লাসিক একটা ভাব আছে। সূক্ষ্ম প্লট ধরে এক দৃষ্টিতে এগিয়ে গিয়েছেন প��রতিটি গল্পে। আশপাশ থেকে একাধিক চরিত্র এনে ঘোলাটে করেননি দৃশ্যপট। গল্পের শেষে কিছুক্ষণ ভেবে দেখার মত রহস্য রেখে সাবলীল ইতি টেনেছেন। ঘটনা ঘটছে, কেন ঘটছে সেটা কল্পনায় ভেবে নেয়ার জন্য যথেষ্ট জায়গা রেখে দিয়েছেন৷ বইয়ের প্রথম গল্প "সংক্ষোভ" সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা দিলেও পড়া শেষ হতে হতে "অবান্তর অথচ অকাট্য" আমার সবচেয়ে পছন্দের।
“চৈত্রের শুরুতে কালবৈশাখী বলে-কয়ে আসে না। প্রতিবছর একই কান্ড ঘটে, তবু আমরা ভুলে যাই। ঠিক যেভাবে আমরা ভুলে যাই দেশের বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিকান্ড, খুন, ধর্ষণ কিংবা জালিয়াতির কথা। ভুলে গিয়ে হয়তো আমরা শান্তি পেতে চাই,চাই অস্থিরতা দূর করতে। নিজেকে বোঝাই, ভালো আছি। এই ভুলে যাওয়া আমাদের মজ্জাগত স্বভাব।”
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর অনুবাদে রেনেগী কদুর লেখা কবিতার একটি লাইন নিয়ে বইটির নামকরণ করা হয়,“যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার।” নামের সাথে গল্পের মিল আছে কিনা আমি খুজে পাইনি কিংবা পেলেও বুঝতে পারিনি।
বেশ কয়েকটি ছোট গল্প নিয়ে লেখকের প্রথম গল্প সংকলন এটি। গল্প গুলো শেষ পর্যন্ত আহামরি তেমন কিছু না। কিন্তু লেখনীয় ধরণ এবং চারপাশের বর্ণনা গল্পগুলোকে জীবন্ত ও সুন্দর করে তুলেছে।
বইয়ের কিছু কিছু লাইন দাগ কেটেছে মনে। কিছু গিয়েছে মাথার উপর দিয়ে। কিছু গল্প নিয়ে গেছে রাজাধর্মপালের সময়কার বৃক্ষদেবতার কাছে।
কোন গল্পে খুনি হতে দেখা গেছে সাত বছরের মেয়েকে। দেখা গেছে একটা ছেলেকে সিরিয়াল কিলার হয়ে যেতে। কখনো দেখা গেছে হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালাকে আমাদের দেশ থেকে মশা তাড়াতে।
খুব একটা ভালো লাগেনি আবার খারাপও লাগেনি। মোটামুটি ধরণের গল্প গুলো। আমি আরো ভালো কিছু আশা করেছিলাম প্রচ্ছদ দেখে।
কিছুদিন যাবৎ ছোটগল্পের প্রতি বেশ আগ্রহ জন্মাচ্ছে। ছোটগল্প পড়ার ইচ্ছে জাগার মূল কারণ হচ্ছে কোনো কাজ বা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে একটা করে ছোটগল্প পড়ে ফেলতে পারব এমন টাইপ ধারণা থেকে। ছোটগল্প পড়ে উপন্যাস পড়া থেকেও বেশি ভালো লাগে। মুগ্ধ হয়ে থাকা যায়। ওই যে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের সংজ্ঞা থেকে — শেষ হয়েও হইলো না শেষ! এইরকম অবস্থায় বসে থাকি ছোটগল্প পড়ে তা নিয়ে ভাবতে বসে যাই। এইরকমই একটা ছোট গল্পের বই হচ্ছে 'যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার' - ওয়াসি আহমেদের লেখা।
যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার ১১ টি ছোটগল্প নিয়ে লেখা একটি বই। প্রত্যেকটি গল্পই একেকভাবে মুগ্ধ করেছে। কি সুন্দর লেখনী। প্রত্যেকটি গল্পে একেক রকমের লেখা। কি বৈচিত্র্য! প্রত্যেকটি গল্পের চরিত্রগুলোও দারুণ। মনে হবে আমাদের খুব কাছে পরিচিত চরিত্র। এই আমাদের পাশের একজন নাহ্, আরেহ্ কালকে যে লোকটাকে দেখলাম তার মতো, কিংবা কোনো পরিচিত কারোর মতো। তাই গল্পগুলো রিলেট করতে আরো বেশি সুবিধা হয়।
এই বইয়ে আমার বেশি ভালো লেগেছে যে গল্পগুলো তা হচ্ছে -
কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল : এক বৃষ্টির সন্ধ্যায় নীলক্ষেতে চার বন্ধু আড্ডার মাধ্যমে কিভাবে লেখক চার্যাপদ, লুই পা, রাজা ধর্মপালকে নিয়ে কি সুন্দর একটা গল্প বলেছেন। পাশাপাশি একটা গাছকে কি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন!
আবার যদি সাতটি তারার তিমির গল্পের কথা বলি : অসাধারণ রোমান্টিক একটা গল্প। বিষন্নতা, একাকিত্বের আগ্যান, দর্শনের মেলবন্ধনে লেখা গল্পটি। আসলেই এই রোমান্টিক ধাঁচের গল্পটি পড়ার পর পাঠকের একটু হলেও মন হারিয়ে যাবে, খানিকটা বিষন্নতা এসে ঘিরে ধরবে।
আবার একজন ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ গল্পটাতে পাওয়া যাবে একজন আর্টিস্ট নির্যাতিত হওয়ার পর কিভাবে উন্মাদে রূপান্তরিত হয় তার গল্প। সুন্দর লেখনী।
বইটাতে একাধারে থ্রিলার, পরাবাস্তব, জাদুবিদ্যা, ফিকশন সবকিছুর ছোঁয়া পাওয়া যাবে। পাঠক চাইলেই পরাবাস্তবের একটা গল্প পড়ে ঢুকে যেতে পারবেন কঠোর বাস্তবধর্মী কোনো গল্পে। লেখকের জাদুবিদ্যার লেখার ধরনটাও বেশ ভালো লেগেছে। ৯৬ পেইজেই ছোট্ট একটা বই পাঠকের জন্য দারুণ একটা যাত্রা হতে বাধ্য।
যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার ওয়াসি আহমেদ অবসর প্রকাশনা
বই - যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার লেখক :- Wasee Ahmed Rafi প্রচ্ছদ :- সজল চৌধুরী প্রকাশকাল :- ফেব্রুয়ারি ২০২০ প্রকাশনী :- অবসর প্রকাশনী পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৯৬ মুদ্রিত মূল্য : ১৮০ টাকা মাত্র
◾▪️কাহিনী সংক্ষেপ
গল্পকে কি আদৌ নতুন করে সৃষ্টি করা যায়? নাকি বাতাসের মতোই চারপাশ থেকে আমাদের জড়িয়ে রাখে ওরা; স্থান-কাল-পাত্রের কাঁধে ভর করে ছড়িয়ে যায়, ঘুরে বেড়ায় সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে!
কেনো এক কাকডাকা ভোরে আব্দুল মোত্তালেবের লোমশ পাজোড়া শূন্যে ঝুলে থাকে? চর্যাপদের আদি কবি লুইপার সাথে এক বৃষ্টিভেজা অন্ধকার সন্ধ্যায় নীলক্ষেতে আটকে পড়া কয়েক জন যুবকের কী সম্পর্ক? মধ্যদুপুরে জনৈক গৃহিণীর জীর্ণশীর্ণ হাত জানালার বাইরে কাকে খোঁজে? অবিরাম জ্বরের দিনগুলোতে শহরের রাস্তায় হাজির হয় কোন সে আগন্তুক?
রোমাঞ্চ, পারিপার্শ্বিক জীবন, রহস্য, আধিভৌতিকতা, দর্শন, পরাবাস্তবতা,এমন অসংখ্য সুতোয় বোনা গল্পে উত্তর মিলবে সব প্রশ্নের। বিচিত্র বিষয়ের আবর্তনেও যার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে বিষন্নতার ছাপ, যে বাক্যে মিশে থাকে অশ্রুত অন্ধকার!
◾▪️পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ-
-------সংক্ষোভ ------ এটি বইয়ের প্রথম গল্প। এই গল্পটি একটি সুখী পরিবারের তাদের সাত বছরের মেয়ে এবং তার ছোট বোনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। গল্পটি সাদামাটা ভাবে এগিয়ে গেলেও সেটা আর শেষে গিয়ে সাদামাটায় থাকেনি। গল্পটা যে শেষে ভয়ঙ্কর হররে রুপান্তরিত হবে সেটা আগ থেকেই বুঝে ফেলেছিলাম।
---------- জীবনের এইসব নিভৃত কুহক --------- এটি বইয়ের দ্বিতীয় গল্প। এই গল্পটি এগিয়েছে একজন গৃহিণীর নিত্যদিনের দৈনন্দিন কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে। সত্যি বলতে কি এইরকম হাজারো গল্প আমাদের চারপাশে বাস্তবে অহরহ হয়ে আসছে। কিন্তু আমরা সেসব দেখি না বা দেখার ভান/চেষ্টাও ও করিনা। বইয়ের শেষ লাইনটা খুবই ভালো লাগার মতো ‘‘ঝাকার ভেতর ঠেসে রাখা মুরগিদের এই কক্কক আওয়াজ ছাপিয়ে নারী কন্ঠের দুর্বল আর্তনাদ জনৈক মুরগির কানে পৌঁছায় না৷’’ তবে গল্পটিতে বিষন্নতা আর একাকীত্বের চাপ স্পষ্ট!
--------- একজন ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ -------- এটি বইয়ের তৃতীয় গল্প। এই গল্পটি একজন মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। যে কিনা ছোট বেলা থেকেই শারীরিক ও মানসিক এবিউজে স্বীকার। আর এর থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্যে ভয়ংকর সব খুন করে নিজেকে সব কিছু থেকে আলাদা করে রেখেছে। এই গল্পটা যে কারোরই মানসিক চিন্তাকে নাড়া দেবে। এক কথায় যদি বলতে হয়, তাহলে এই গল্পটা দারুন মনস্তাত্ত্বিক সিরিয়াল কিলিংয়ে গল্প। খুবই ভালো লেগেছে গল্পটা।
--------- কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল ---------এটি বইয়ের চতুর্থ গল্প। সত্যি বলতে কি, এই গল্পটা আমার সব চেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছে। এক বৃষ্টিভেজা বিকালে চার বন্ধুর শোনা এক অদ্ভুত কাহিনী নিয়েই গল্পটি। গল্পেটি প্রথম থেকে একদম শেষ পর্যন্ত দুর্দান্ত! দুর্দান্ত! দুর্দান্ত!।
রবীন্দ্রনাথের মতে," যে গল্প শেষ হইয়াও শেষ হয় নাই সেটাই ছোট গল্প"। "কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল" সেইরকমি একটি গল্প। যেটা শেষ হওয়ার পরেও একরাশ মুগ্ধতা থেকে গিয়েছে। আর এভাবেই ছোট গল্পের স্বার্থকতা খুঁজে পাক বেশি বেশি.......♥
-------- বিকৃতি -------- এটি বইয়ের পঞ্চম গল্প। গল্পটি হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। গল্পটিতে এক দারুন বার্তা দেওয়া হয়েছে। আমার মনে হয়েছে এই বার্তাটা দিতে ভাই��়া পুরোপুরিভাবে সফল হয়েছেন। শুধু একটা কথাই বলবো, বিকৃতি শুধু মানুষের চরিত্রেই হয় তা কিন্তু না,মানুষের আত্বার ও বিকৃতি হয়। খুবই ভালো গল্প।
-------- জ্বরের দিন গুলোতে এক কাল্পনিক নগরীর মিথ্যা উপাখ্যান ------ এটি বইয়ের ষষ্ঠ গল্প। বর্তমান সময়ের প্রেহ্মাপটে গল্পটা খুবই মানানসই। যাকে এক কথায় বলে খাপে খাপ আরকি। আমাদের দুই সিটি করপোরেশনের দুই মেয়রের যে মিথ্যা আশ্বাসে পাবলিক দিন দিন যে বোকা হচ্ছে, কেবল সেই কথাটাই মনে হচ্ছিলো গল্পটা পড়ে! গল্পটা খুবই ছোট হলেও এর বার্তাটা ছিলো গভীর। আচ্ছা হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা কি আর কখনো আমাদের এই নগরে ফিরে আসবে??
-------- সাতটি তারার তিমির ------- এটি বইয়ের সপ্তম গল্প। গল্পটি রোমান্টিক ভাবে শুরু হলেও শেষে গল্পটা বিষন্নতা আর একাকীত্বে পরিপূর্ণ হয়ে শেষ হয়েছে। গল্পের বার্তটা আসলে বস্তবতা স্বরুপ। বেশির ভাগ ভালোবাসাগুলো আসলে এমনি হয়.....। এই গল্পটা পড়ার পর আরো বেশি মনে হলো ভাইয়ার লেখা আরো প্রানবন্ত আরো সতেজ! গল্পের ভিতরে উপমাগুলো আর কোটেশন গুলো বেশ ভালো লাগার মতো। "৭" সংখ্যাটা বিভিন্ন পুরান, বিভিন্ন ধর্মে বেশ গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা হিসেবে বিবেচিত। আর এই সংখ্যা নিয়ে দারুন এক তথ্য জানতে পারবেন বইয়ের শেষে।
-------- অবান্তর অথচ অকাট্য ------- এটি বইয়ের অষ্টম গল্প। বেশ অদ্ভুত গল্প। গল্পের চাইতে গল্পে লেখার বুনন টি ছিলো অসাধারন! গল্পের বুনন দেখে আমি মুগ্ধ। এই গল্পটিতে "ম্যাজিক রিয়েলিজম" সুন্দর ভাবেই বুনন করা হয়েছে। আশা করছি আপনারও আমার মতো গল্পের বুনন দেখে মুগ্ধ হবেন।
অবশ্য আব্দুল মোত্তালেবের মৃত্যুর সুস্পষ্ট কারন অনুসন্ধান করতে গেলে অবান্তর অথচ অকাট্য প্রশ্নের সংখ্যা আরো একটা বেড়ে যাবে।
-------- চক্র ------- এটি বইয়ের নবম গল্প। বেশ ভালো লেগেছে গল্পটি। জাহিন নামের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক ছাত্রকে কেন্দ্র করে লেখক কল্পিত এক ভিন্ন জগত সৃষ্টি করেছেন। পুরো গল্পের দুই-তৃতীয়াংশ ম্যাজিক রিয়েলিজমের মাধ্যমে সাজানো হয়েছে। গল্পের প্লটটা সুন্দর ছিলো।
-------- নিয়তি ------- এটি বইয়ের দশম গল্প। আজগর নামের এক লোককে ব্ল্যাক মেইল করা নিয়ে কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। গল্পের প্লটটা বেশ সুন্দর ও গোছানো ছিলো। পুরো বইতে এটাই একমাত্র এডাপটেশন গল্প। ভালো লোগেছে গল্পটি।
-------- তিনটি বাজে গল্প -------- এটি বইয়ের একাদশ গল্প। এই গল্পটি পুরোপুর�� অদ্ভুত। আমার তো মনে হচ্ছে পাঠকদের বিভ্রান্তিতে ফেলে দেওয়ার জন্যেই ভাইয়া ইচ্ছে করে এইরকম অদ্ভুত গল্প ঢুকিয়ে দিয়েছেন। যতটুকু পড়ে বুঝালম গল্পগুলোতে ম্যাজিক রিয়েলিজম ব্যবহার করেছে। সে হিসেবে গল্পগুলো ঠিক আছে।
প্রতিটি গল্পের বইয়ে দুই একটা গল্প থাকবে যেগুলো আপনার মাথার উপর দিয়ে, নিচ দিয়ে যাবে। এই গল্পটাও ঠিক সেরকম। একেবারে........... 😍
"যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার" গল্পের বইটিতে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে লেখকের লেখার বুনন। কয়েকটি গল্পের বুনন এতোই দারুন ছিলো যে, যেটা আসলে সত্যিই মুগ্ধ করার মতো। আপনারা না পড়লে বুঝতেই পারবেন না। বইটির প্রচ্ছদ খুবই নান্দনিক ছিলো। এবারের বই মেলায় সব থেকে সেরা প্রচ্ছদ এটি। এর চেয়ে ভালো প্রচ্ছদ আর হয়নি! এই বইটিতে প্রতিটি গল্পের জন্যে আলাদা আলাদা ইলাস্ট্রেশন সংযোগ করা হয়েছে। বইয়ের বাঁধাই, কাগজ আর বাইন্ডিং মিলিয়ে সব কিছুই উন্নতমানের।
সব শেষে একটা কথাই বলবো,বইটি আমার খুবই ভালো লেগেছে। সামনের বছরে এইরকমি আরেকটি দারুন বই ভাইয়ার কাছে প্রত্যাশা রাখছি।😊
ওয়াসি আহমেদের লেখার সাথে প্রথম পরিচয় হান্নান বোতলে আটকে রাখে দিয়ে।তারই ধারাবাহিকতায় পড়লাম যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার।মোটামুটি মানের ছোট গল্প,২-১টা বেশ ভালো।তবে লেখক বোধহয় হিউমার সমৃদ্ধ লেখা একটু বেশি ভালো লিখেন।বই সম্পর্কে এক বাক্যে- "ভালো তবে আরো ভালো হতে পারতো,কোথায় গিয়ে যেনো একটা খামতি রয়ে গেছে।"